কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

টেকনাফে আরও ৬৩ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই, দাবি মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন

টেকনাফ স্থলবন্দরের মালঞ্চ সম্মেলনকক্ষে আজ বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টা পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল আরও ৬৩ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

তবে অধিকাংশ রোহিঙ্গা সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের বলেছেন, নাগরিকত্ব দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনব্যবস্থা শুরু করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে থাকা কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরতে রাজি হবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্বিতীয় দিনে আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু হয়। বেলা দেড়টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ৬৩ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করা হয়েছে। দুপুরের খাবারের এক ঘণ্টা বিরতি শেষে বেলা আড়াইটায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আরও কিছু রোহিঙ্গা পরিবারের সাক্ষাৎকার ও তথ্য যাচাইয়ের কথা রয়েছে। আগের দিন বুধবার একই সম্মেলনকক্ষে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ২৯টি পরিবারের ৯৩ রোহিঙ্গা। টেকনাফ স্থলবন্দরের অভ্যন্তরে ত্রিপল টাঙিয়ে সেখানে রাখা হয়েছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের। অধিকাংশ রোহিঙ্গা এসেছে টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির থেকে।

প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে গতকাল বুধবার সকালে নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে আসে দেশটির ২২ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে গতকাল বুধবার সকালে নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে আসে দেশটির ২২ সদস্যের প্রতিনিধিদল। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ।

দ্বিতীয় দিনের মতো রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং তথ্য যাচাই শুরু কথা জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা (মিয়ানমার প্রতিনিধিদল) ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করবেন। প্রতিদিন ৬০ থেকে ১০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় দিন সময় লেগে যেতে পারে। আমরা তাঁদের সহযোগিতা দিচ্ছি।’

আরআরআরসি কার্যালয়ের তথ্যমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি ৪২৯ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার এবং তথ্য যাচাইয়ে টেকনাফে এসেছে ।

আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মালঞ্চ সম্মেলনকক্ষে তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু করেন মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।

সাক্ষাৎকারের জন্য তালিকাভুক্ত টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবাগান আশ্রয়শিবির থেকে শতাধিক রোহিঙ্গাকে গাড়িতে করে বন্দরে আনা হয়। সেখানে প্যান্ডেলে রোহিঙ্গাদের চেয়ারে বসানো হয়। পরে একজন করে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। সাক্ষাৎকার শেষে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলটি একটি কাগজে টিপসই নিয়ে রাখছে। কিন্তু সেটি কেন জিজ্ঞাসা করেও জবাব পাচ্ছেন না রোহিঙ্গারা।

রাখাইন রাজ্যের ঠিকানা শনাক্ত করতেই বেশি আগ্রহী মিয়ানমার দলটি। কিন্তু প্রতিনিধিদলকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আমরা শুধু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফিরে এসেছি
কাদির হোসেন, টেকনাফের জাদিমোরা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা
টেকনাফের জাদিমোরা আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-২৭) রোহিঙ্গা কাদির হোসেন (৫৫) এসেছেন সাক্ষাৎকার দিতে। দুপুর ১২টার দিকে তিনি মিয়ানমার দলের মুখোমুখি হন। ১৫ মিনিট পর বেরিয়ে এসে তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের ঠিকানা শনাক্ত করতেই বেশি আগ্রহী মিয়ানমার দলটি। তাঁরা (প্রতিনিধিরা) জানতে চেয়েছেন, রাখাইন রাজ্যের কোন গ্রামে বসতবাড়ি ছিল, সেখানকার ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্য কে ছিলেন? সেখানে থাকতে কতজন সন্তান ছিল, বাংলাদেশে এসে কতজন সন্তান জন্ম নিল ইত্যাদি। কিন্তু প্রতিনিধিদলকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আমরা শুধু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফিরে এসেছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন রোহিঙ্গা বলেন, ‘প্রতিনিধিদলের কাছে কয়েক রোহিঙ্গা জানতে চেয়েছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কখন শুরু হবে? প্রত্যাবাসন শুরুর আগে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে কি না। প্রতিনিধিদলের কোনো সদস্যই এ প্রশ্নের জবাব দেননি। সাক্ষাৎকারের জন্য সম্মেলনকক্ষে ঢোকার আগেই রোহিঙ্গাদের বলে দেওয়া হয়, মিয়ানমার প্রতিনিধিদলকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।’

হামিদা খাতুন নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের এক সদস্য তাঁর কাছে জানতে চেয়েছেন, কত সালে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন, তা আবার কোন পথে—নাফ নদী অতিক্রম করে নাকি নাইক্ষ্যংছড়ির স্থলপথে। এখন ঘরে কতজন ছেলেমেয়ে আছে? এর মধ্যে বাংলাদেশে কতজন সন্তান জন্ম নিয়েছে, এসব প্রশ্ন করা হয়। জবাব দেওয়ার পর রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমার সরকার রাজি কি না, জানতে চাইলে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা চুপ থাকেন। তখন এক সদস্য কাগজে দ্রুত টিপসই নিয়ে তাঁকে বাইরের প্যান্ডেলের দিকে পাঠিয়ে দেন।’

কয়েক রোহিঙ্গারা বলেন, ‘আমরা (রোহিঙ্গা) চাই, দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু হোক।রাখাইনের জন্মভূমিতে ফিরতে চাই বলেই আমরা মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সামনে হাজির হয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করছি। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে জন্মভূমিতে ফেরার মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে আগ্রহ না দেখালে কোনো রোহিঙ্গা ফিরে যেতে রাজি হবে না।

টেকনাফ স্থল বন্দরে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎকার দিয়ে আশ্রয়শিবিরে ফিরছেন রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যরা

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর এসেছেন। কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেয়নি। সূত্র প্রথম আলে

পাঠকের মতামত: